Image

Image

0
বর্তমানে ভয়াবহ এবং ব্যায়বহুল রোগগুলোর মধ্যে একটি থ্যালাসেমিয়া রোগ। যা মানুষের মৃত্যুর কারণও হতে পারে। এটি সাধারণত একটি বংশগত রোগ, যাতে রক্তে হিমোগ্লোবিন এর পরিমাণ কমে যায়। রোগীকে বাচিয়ে রাখতে আজীবন রক্ত দিয়ে যেতে হয়। পরিবার কে যেতে হয় সীমাহীন আর্থিক ও মানসিক দুর্দশার মাঝ
দিয়ে।



*** থ্যালাসেমিয়া হওয়ার কারনঃ
থ্যালাসেমিয়া হল হিমোগ্লোবিন রক্তের খুবই গুরত্বপূর্ণ উপাদান। আমরা নিশ্বাসের সঙ্গে যে অক্সিজেন বহন করি,
হিমোগ্লোবিনের কাজ হলো তা শরীরের সমস্ত অংশে বহন করে নিয়ে যাওয়া। হিমোগ্লোবিন তৈরী হয় দুটি আলফা প্রোটিন ও দুটি বিটা প্রোটিন দিয়ে। যদি এই প্রোটিন গুলোর উৎপাদন শরীরে কমে যায়, তবে শরীরের হিমোগ্লোবিনের উৎপাদনও কমে যায় এবং থ্যালাসেমিয়া দেখা দেয়। আলফা ও বিটা প্রোটিন তৈরী হয় জীন হতে। কেউ যখন কোন ত্রুটিপূর্ণ জীন তার বাবা- মায়ের কাছ হতে বংশানুক্রমে পায়, তখনই মূলত থ্যালাসেমিয়া দেখা দেয়। সুতরাং থ্যালাসেমিয়া একটি বংশগত রোগ। ত্রুটিপূর্ণ জীন বহন কারীর তাই এটি প্রতিরোধের কোন উপায় নেই।


*** থ্যালাসেমিয়ার প্রকারঃ থ্যালাসেমিয়া দুই প্রকার-
১. আলফা থ্যালাসেমিয়াঃ কারো শরীরে আলফা প্রোটিন কম তৈরী হলে তাকে বলা হয় আলফা থ্যালাসেমিয়া।
লঘু আলফা থ্যালাসেমিয়া (ইংরেজীতে থ্যালাসেমিয়া মাইনর) তে আলফা প্রোটিন কিছুটা কম তৈরী হয় আর মারাত্মক আলফা থ্যালাসেমিয়া (ইংরেজীতে থ্যালাসেমিয়া মেজর) তে আলফা প্রোটিন অনেক কম তৈরী হয়।
থ্যালাসেমিয়া মেজর হলে শিশু গর্ভাবস্থায় অথবা জন্মের পরপরই মারা যায়।


২. বিটা থ্যালাসেমিয়াঃকারো শরীরে বিটা প্রোটিন কম তৈরী হলে তাকে বলা হয় বিটা থ্যালাসেমিয়া।
বিটা থ্যালেমিয়া তে রোগের তীব্রতা আলফা হতে অনেক বেশী। রোগী যদি শিশু হয় তবে অঙ্গহানী ও মৃত্যু পর্যন্ত
হতে পারে। লঘু বিটা থ্যালাসেমিয়া (ইংরেজীতে থ্যালাসেমিয়া মাইনর) তে বিটা প্রোটিন কিছুটা কম তৈরী হয় আর
মারাত্মক বিটা থ্যালাসেমিয়া (ইংরেজীতে থ্যালাসেমিয়া মেজর) তে বিটা প্রোটিন অনেক কম তৈরী হয়।
থ্যালাসেমিয়া মেজর এর চাইতে মাইনর এর তীব্রতা কম। সুতরাং থ্যালাসেমিয়া মেজর ও মাইনরএর জন্য চিকিৎসাও ভিন্ন হয়।



*** থ্যালাসেমিয়ার লক্ষনঃ
– অবসাদ অনুভব করা
– দূর্বলতা
– শ্বাসকষ্ট
– পেট ফুলে যাওয়া
– গাঢ় রঙের প্রস্রাব – মুখ-মন্ডল ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
– ত্বক হলদে হয়ে যাওয়া (জন্ডিস)
– মুখের হাড়ের বিকৃতি
– নাকের হাড় বসে যাওয়া (চাইনিজদের মতো চেহারা)
– শারীরিক বৃদ্ধি কমে যাওয়া
কীভাবে রোগ নির্ণয় করা যায়ঃ 

যদি কারও উপরের লক্ষন গুলো অথবা অ্যানিমিয়া/ রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ কম থাকে, তাহলে চিকিত্সকের পরামর্শ অনুযায়ী রক্তের পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হতে হবে যে এটা থ্যালাসেমিয়া কিনা। যদি থ্যালাসেমিয়া হয়ে থাকে তবে মাইনর নাকি মেজর সেটাও নিশ্চিত হতে হবে। এরপরেই চিকিৎসার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া
যাবে। থ্যালাসেমিয়া মাইনর বা বাহক শনাক্তকরণের জন্য যে রক্ত পরীক্ষা করতে হবে তার নাম, হিমোগ্লোবিন
ইলেকট্রোফোরেসিস। বারডেমে, সি.এম.এইচ, পিজি, কেয়ার হসপিটাল, পদ্মা ডায়াগনোস্টিক ও আই.সি.ডি.ডি.আর.বিতে এ পরীক্ষা করানো হয়। খরচ পরবে ৮০০-৯০০ টাকা।




*** থ্যালাসেমিয়া রোগের ভয়াবহতাঃ

– রক্ত পরিবর্তন অথবা রোগের কারণে রক্তে আয়রণের পরিমাণ বেড়ে যায়। রক্তে আয়রনের পরিমাণ বেড়ে গেলে তা হৃৎপিন্ড, যকৃত এবং হরমোন ব্যবস্থা কে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এর লক্ষন প্রকাশিত হতে থাকে নানাভাবে।
– রক্ত পরিবর্তনের কারণে রক্ত বাহিত বিভিন্ন রোগ (যেমন-জন্ডিস, এইচআইভি, হেপাটাইটিস ‘বি’ ও
‘সি’ ভাইরাসজনিত রোগ) এর সংক্রমণ এর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। রোগীকে তাই প্রচন্ড সাবধানে চলাফেরা করতে হয় নয়ত যে কোন মুহুর্তে অন্য যে কোন রোগের জীবানু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যেতে পারে।
– রক্ত তৈরী হয় হাড়ের ভেতর কার অস্থিমজ্জা (bone marrow) থেকে। শরীর চেষ্টা করে হিমোগ্লোবিন এর অভাব দূর করতে অনেক বেশী রক্ত তৈরী করতে, ফলে অস্থিমজ্জার উপর বেশী চাপ পরে ও অস্থিমজ্জা প্রসারিত হয়ে
যায়। এর ফলে হাড় পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে যায়। এতে মেরুদন্ডের হাড় ভেঙ্গে যাবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। নাকের হার বসে গিয়ে, মুখের হার বৃদ্ধি পেয়ে চেহারা বিকৃত হয়ে যেতে পারে।
– ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন পরিষ্কারের কাজে নিয়োযিত থাকে প্লীহা (speen)। প্লীহার উপর অতিরিক্ত কাজের চাপ পরে ও প্লীহা প্রসারিত হয়ে যায়। রোগীর পেটের আয়তন বৃদ্ধি পায়। মোটকথা আস্তে আস্তে পুরো শারীরিক
কার্যক্রমের ব্যালেন্স ই নষ্ট হয়ে যায়।


*** থ্যালাসেমিয়া রোগের চিকিৎসাঃ

– মৃদু থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে লক্ষণ ও উপসর্গ খুবই কম থাকে এবং এক্ষেত্রে খুবই অল্প চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে যেমন-কোন অপারেশন হলে বা প্রসবের পর অথবা কোন সংক্রমণ হলে প্রয়োজন বোধে
রক্ত দেয়া (Blood transfusion) লাগতে পারে।
– মাঝারি থেকে মারাত্মক থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে, বছরে বেশ কয়েকবার প্রয়োজনবোধে ৮ থেকে ১০ বার রক্ত দেয়া লাগতে পারে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন (Bone Marrow transplant) করার প্রয়োজন হতে পারে।
পাশাপাশি ডাক্তারে রপরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করতে হবে। জীবন-যাপন পদ্ধতি থ্যালাসেমিয়ার রোগীকে
বাঁচিয়ে রাখতে দিনের পর দিন রক্ত দিয়ে যেতে হয়। প্রতি ব্যাগ রক্তের সঙ্গে শরীরে জমা হয় আয়রন। এই অতিরিক্ত আয়রন গিয়ে জমে লিভার ও প্যানক্রিয়াস (যেই অংগ থেকে ইনসুলিন তৈরী হয়) এ।
ফলে লিভার সিরোসিস ও ডায়বেটিস (প্যানক্রিয়াস ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে কম ইনসুলিন তৈরী হওয়ার ফলে) দেখা দেয়।
ডাক্তারের নির্দেশনা ছাড়া তাই আয়রণযুক্ত ঔষধ, ভিটামিন বা অন্যকোন ঔষধ খাওয়া যাবে না। সুষম ও পুষ্টিকর
খাবার বিশেষ করে ক্যালসিয়াম, জিংক, ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। যাতে অন্য কোন জীবানু দিয়ে আক্রান্ত না হন তার জন্য বারবার হাত ধুতে হবে, অসুস্থ ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকতে হবে, বাইরের খাবার খাওয়া
যাবেনা ও সংক্রমণ এড়াবার জন্য বিভিন্ন রোগের টিকা নি্যে রাখতে হবে। বিয়ের আগে যা করবেনঃ আপনি যদি থ্যালাসেময়ার রোগী বা বাহক হন, বিয়ের আগে অবশ্যই রক্ত পরীক্ষা করে  জেনে নিন যে আপনার হবু জীবনসঙ্গী ও এই রোগের রোগী বা বাহক কিনা। কেননা আপনাদের বিয়ে হলে, হবু সন্তান হতে পারে এই রোগের শিকার। আপনি গর্ভবতী হলে কি করবেন? বাবা ও মা দুজনেই যদি থ্যালাসেমিয়ার বাহক হয়, তবে প্রতি ৪ জন সন্তানেরর
মধ্যে একজনের থ্যালাসেমিয়ার রোগী হওয়ার, দুইজনের থ্যালাসেমিয়ার বাহক হওয়ার এবং একজনের স্বাভাবিক সম্ভাবনা থাকে। সেই ৪ জনের মধ্যে যে থ্যালাসেমিয়ার রোগী হবে সে আপনার কততম সন্তান তা নিশ্চিত করে বলা যায়না। তাই প্রতিবার গর্ভবতী হওয়ার পরই গর্ভস্থ সন্তান কে পরীক্ষা করান। পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যাবে যে শিশুটি এইই রোগের বাহক বা রোগী কিনা। রোগী হলে সে মেজর নাকি মাইনর থ্যালাসেমিয়া তে ভুগছে
কিনা। এরপর বাবা-মায়ের ইচ্ছায় ও ডাক্তারের পরামর্শে শিশুর ভ্রুণ নষ্ট করে ফেলা যেতে পারে (নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত
হলেও, এটা শিশুটাকে একটি দুঃখময় জীবন হতে বাচাবে)। এই ক্ষেত্রে যে পরীক্ষা গুলো করা হয় সেগুলো হলো :
– কোরিওনিক ভিলিয়াসস্যাম্পলিং (Chorionic villus sampling)
– অ্যামনিওসেনটিসিস (Amniocentesis)
– ফিটাল ব্লাড স্যাম্পলিং (Fetal blood sampling)
ডি.এন.এ সলিশন লিমিটেড (পান্থপথ) এ, আপনি গর্ভবস্থায় পরীক্ষার মাধ্যমে শিশুর থ্যালাসেমিয়া নির্ণয় করতে পারবেন। গর্ভাবস্থার ১৬ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে পরীক্ষাটি করালে ভালো হয়য়। খরচ
পরে প্রায় ১৫ হাজার টাকা।
-জেনেটিক রোগ সম্পর্কে সচেতন না থাকা ও আত্মীয়দের মধ্যে বিয়ের কারণে বাংলাদেশ, পাকিস্তান এইসব দেশগুলোতে থ্যালাসেমিয়ার দ্রুত বিস্তার ঘটছে। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় আট থেকে দশ হাজার শিশুর জন্ম হচ্ছে থ্যালাসেমিয়া নিয়ে। ইতঃমধ্যে সারাদেশে লআক্রান্তর সংখ্যাল প্রায় সাড়ে তিন লাখেরও বেশি শিশু। দেশে এ রোগের বাহক প্রায় দেড় কোটি মানুষ। তাই দ্রুত এই রোগ প্রতিরোধে সবাইকে সতর্ক হতে হবে। আমরা চাইলে আমাদের সমাজ হতে এই রোগ সম্পূর্ণ নির্মূল করতে পারি। প্রথমত বিয়ের আগে রক্তপরীক্ষা করে আমরা জীবনসঙ্গী
নির্বাচন করতে পারি, যাতে কোনভাবে দুজন বাহকের বিয়ে না হয়ে যায়। দ্বীতিয়ত, যদি বিয়ে হয়েই যায়,
গর্ভস্থ সন্তান কে পরীক্ষা করে, তার জন্মের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। এই ভাবে একদম সবাই সচেতন হলে আমাদের সমাজ থেকে ত্রুটিপূর্ণ জীনের বিস্তার ঠেকানো এবং একসময় সম্পূর্ণ নির্মূল সম্ভব। উল্লেখ্য যে, সাইপ্রাসে
যেখানে আগে প্রতি ১৫৮ জন শিশুর একজন ছিলো থ্যালাসেমিয়ার রোগী, গর্ভস্থ পরীক্ষার মাধ্যমে এখন এই রোগীর সংখ্যা শুণ্যে নামানো সম্ভব হয়েছে।

সংগৃহীত ও সম্পাদিত 

Post a Comment

Dear readers, after reading the Content please ask for advice and to provide constructive feedback Please Write Relevant Comment with Polite Language.Your comments inspired me to continue blogging. Your opinion much more valuable to me. Thank you.